
◻️ জসিম উদ্দীন মাহমুদ তালুকদার, চট্টগ্রাম
বর্ণ দুধসাদা কুর্চিফুল এবং তীব্র সুগন্ধী কিন্তু মধুর।
ফুল হিসেবে কৃষ্ণচূড়া, জারুলের মতো কদর না থাকলেও পাহাড়ে গ্রামে সাদা পাঁপড়ির সুবাস ছড়াচ্ছে কুর্চি। এ ফুল সাহিত্যে জগতে দখল করে নিয়েছে এক স্বতন্ত্র স্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলের সৌন্দর্য ও প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে তাঁর কবিতায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বনবাণী কাব্যগ্রন্থে ‘কুরচি’ শিরোনামে কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল। সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত।’ কবিতায় তিনি কুরচি ফুলকে সমাজের অবহেলিত সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।’সাহিত্যে করে নিয়েছে এক স্বতন্ত্র স্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলের সৌন্দর্য ও প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে তাঁর কবিতায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বনবাণী কাব্যগ্রন্থে ‘কুরচি’ শিরোনামে কবিতায় তিনি লিখেছেন, কুরচি ফুলকে সমাজের অবহেলিত সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে লিখেছেন, ‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।’
কদিন আগেই প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের আগমন ঘটেছে। ফেলা আসা বসন্তে ঝরে গেছে শিমুল, পলাশ। ফাইশ্যা উদালের ফুল ঝরে গিয়ে এখন থোকায় থোকায় ফলের সম্ভাষণ। গ্রীষ্মের ফুল কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল, লাল সোনাইল এখনো পরিপূর্ণভাবে পেখম মেলেনি। পাতা ঝরার সময় পেরিয়ে নবপত্র–পল্লবে মুখরিত বিভিন্ন বৃক্ষ। তবে গ্রীষ্মে ফুলের দূত জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু’র চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছড়ানোর আগে পাহাড় ও গ্রামের বাঁকে বাঁকে পথে রাজত্ব করছে শ্বেত কুরচি ফুল। রঙ সাদা। সুতীব্র ঘ্রাণ। মোহনীয় এ গন্ধে কুরচির পাশে হেঁটে যাওয়া পথিক থমকে দাঁড়ায়। ফুলের গন্ধে বিভোর হচ্ছে নির্সগপ্রেমীরা।
চট্টগ্রামে পাহাড়ি পথে গ্রামের আঁকাবাকা পথে সাদা কুরচি বিভিন্ন বুনো গাছের ভিড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কুরচি। সবুজ পাহাড়ে সাদা ফুল কুরচি যেন পেখম মেলেছে। সড়কের পাশের কুরচি গাছগুলো আঁকারে বেশ ছোট। তবে প্রতিটি গাছে ফুল ফুটে আছে। বড় কুরচি গাছ দেখা গেছে কাপ্তাই, কর্ণফুলী, বাঁশখালীর পাহাড়ে ও বিভিন্ন গ্রামে। উচ্ছতায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট। পুরো গাছে যেন পাতার চেয়ে বেশি ফুল ফুটেছে। বিকেল বা সন্ধ্যার পর কোলাহলমুক্ত গ্রামের রাস্তায় সৌরভ ছড়ায় কুরচি। গ্রীষ্মের হালকা বা মাঝারি বৃষ্টির পর শ্বেত কুরচি আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠে। ফুলের পাঁপড়িতে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা তাকে আরো বেশি স্নিগ্ধ করে তোলে। বৃষ্টির পর ঝরে যাওয়া ফুলে ধবধবে সাদা হয়ে উঠে কুরচি তলা।
পাহাড়ের কুরচিসহ বিভিন্ন ফুল নিয়ে কষ্টের কথা জানালেন হিল অর্কিড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাথোয়াই মারমা। তিনি বলেন, নির্বিচারে পাহাড়ে আগুন দেয়া এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফুলের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। এতে কুরচি, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু অনেক গাছই কাটা পড়ে। শহরের ভেতরের কুরচি রয়েছে হাতে গোনা। তবে শহর থেকে বের হলে পাহাড় ও গ্রামের পথের বাঁকে বাঁকে কুরচি ফুলের সৌন্দর্য দেখা যায়। এটির ওষুধিগুণও রয়েছে। পাতা আর বাকল আমাশয় নিরময়ে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রাম ও পাহাড় জুড়ে এখন কুরচির মুগ্ধতা।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বায়োডাইভার্সিট কনজারভেশন সোসাইটি অব সিএইচটি সংগঠক প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, পাহাড়ে এই সময়ে শ্বেত কুরচি দেখা যায়। এটি মূলত পাহাড়ি এলাকার ফুল। কুরচি গাছ কাটার পরও শেকড় থেকে নতুন চারা জন্মায় এবং ফুল ফুটে। কুরচির তীব্র ঘ্রাণ মোহনীয়। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটির বিভিন্ন সড়কে বেশি দেখা গেছে এবং সংখ্যায় বেশ রয়েছে। এখন কুরচি ফুলের সময়।
কুর্চি-মঞ্জরীতে ফুলের সংখ্যা কম হলেও বিক্ষিপ্ত মঞ্জরী সংখ্যা অজস্র। ফুল রঙ্গন ফুলের মতো, নিচের অংশ নলাকৃতি এবং উপর মুক্ত পাপড়িতে ছড়ানো। ৫টি পাপড়ির মুক্ত অংশ ঈষৎ বাঁকানো, বর্ণ দুধসাদা এবং তীব্র সুগন্ধী কিন্তু মধুর। গোত্রীয় বৈশিষ্ট্যের রীতি অনুযায়ী পরাগচক্র দলের গভীরে অদৃশ্য। দুটি গর্ভকেশর প্রায় মুক্ত এবং এজন্য একই ফুল থেকে দুটি ফল জন্মে। এই স-জোড় ফল দুটি সরু, লম্বা এবং বীজ বহু সংখ্যক, রোমশ ও ঘনবাদামী। বাতাসে বীজ ছড়ায়।
ফুলপ্রেমী লেখক ও সাংবাদিক জসিম তালুকদার বলেন, এই বিশাল পৃথিবীতে কত সম্পর্কই ঝড়ের ভুলের মতো,ফুলের মতো বৃন্তচ্যুত হয়ে দুর্দম হাওয়াতে ভেসে নিরুদ্দেশে উড়ে যায় রোজ। যারা জানে, তারাই জানে কুর্চি,কামিনি, বেলী, গিরিমল্লিকা, পারিজাত, পারুল, ধুতুরা, সন্ধ্যামালতী,সূর্যমুখী, গাঁদা, কদম, মাধবী, মহুয়া, কেয়া বা কেতকী, বকুল, কনকচাঁপা, নাগকেশর, অতসী, নয়নতারা, অপরাজিতা, ঝুমকো লতা, নার্গিস, রজনীগন্ধা, পলাশ কিংবা কিংশুক, শিমুল, পিয়াল, টগর, হাসনাহেনা, জুঁই, চাঁপা ইত্যাদি নানান ফুলের খোঁজ।