ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব ও যৌন হয়রানির অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধে! তদন্তে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে শিক্ষক

হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি:

নোয়াখালী হাতিয়া উপজেলার আওতাধীন ১নং হরণী ইউনিয়নের হাতিয়া বাজারের পাশে অবস্থিত, হাতিয়া জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগ ও তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত শিক্ষককে চূড়ান্তভাবে অপসারণ না করার ঘটনায় স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

 

প্রথম অভিযোগটি উঠে ২০২২ সালে, যখন ষষ্ঠ শ্রেণির এক কোমলমতি শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান অভিযোগ করে যে আজিজুর রহমান তাকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সরাসরি বিদ্যালয় অফিসে অভিযোগ জানান এবং পরবর্তীতে তার অভিভাবক লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।

এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিতে ছিলেন মোহাম্মদ আলী কলেজের অধ্যক্ষ আজমীর হোসেন, হাতিয়া ওছখালী এ এম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও হাতিয়া উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. হাসান, জাহাজমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সোলাইমানসহ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তদন্তে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে শিক্ষককে ৬ মাসের জন্য বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, মাত্র ৪ মাস পরই বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক জহির রায়হান ও স্থানীয় বিএনপির কয়েক নেতাকর্মীর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, বহিষ্কারের সময়টিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে হাজিরা খাতায় তার উপস্থিতি দেখানো হয় এবং তিনি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন।

 

দ্বিতীয় অভিযোগটি আসে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষাকালীন সময়ে। আয়েশা আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিতে আসা এক ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে আজিজুর রহমান হাত দেন এবং তাকে উত্যক্ত করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সরাসরি বিদ্যালয় অফিসে অভিযোগ করলেও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ নিয়ে আয়েশা আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়।

 

৭ই জুলাই ২০২৪শে সর্বশেষ অভিযোগটি ওঠে, যখন সপ্তম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীকে একইভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রথমে সহকারী শিক্ষিকা ফারজানা বেগমকে এবং পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সহকারী শিক্ষিকা ফাতেমা ইসরাত ডলিকে বিষয়টি জানান।

প্রধান শিক্ষক মো. আলী মানসুরের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটিতে ছিলেন জহির রায়হান, ফাতেমা ইসরাত ডলি, মিনারা বেগম ও ফারজানা বেগম। কমিটি অভিযোগ সত্য বলে রিপোর্ট দিলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার তিন সহপাঠী সুবর্ণা আক্তার, তাসলিমা আক্তার ও অরিনকে নিয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।

এ সময় সহকারী শিক্ষক জহির উদ্দিন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষক কিছুদিন পলায়নরত থাকলেও ৫ আগস্ট ২০২৪ ইং আবারও বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।

 

এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং প্রধান শিক্ষকের সাথে এক জরুরি সভায় মিলিত হন। সভায় ৩০-৩৫ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। প্রধান শিক্ষক মো. আলী মানসুর সকল অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন বলে উপস্থিতরা জানান।

তবে প্রধান শিক্ষক তার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে বলেন, আজিজুর রহমান এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় সরাসরি বহিষ্কার করা সম্ভব নয়। এভাবে বহিষ্কার করলে তিনি স্কুলে আসবেন না কিন্তু বাসায় বসে বেতন পাবেন।

উল্লেখ্য চলতি মাসের পাঁচ তারিখে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি টিকটক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক আজিজুর রহমানের উপস্থিতিতে ক্লাসরুমে ছাত্র-ছাত্রীরা টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে।

ভিডিওটি নিয়ে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহির রায়হান প্রথমে দাবি করেন, এটি স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সময়ের ভিডিও। সেদিন টাইফয়েডের ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশনের জন্য অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্কুলে মোবাইল নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছিল।

তবে তার এই বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যখন প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. মাজেদুর রহমান পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে কলমের ক্যাপ খোলা, বই খোলা, কিছু ছাত্রী খাতায় লিখছে এবং শিক্ষক আজিজুর রহমান সামনে বই নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। স্কুল বন্ধ থাকলে এই দৃশ্য কীভাবে সম্ভব?

এ প্রশ্নের জবাবে জহির রায়হান তার বক্তব্য পরিবর্তন করে বলেন, আসলে সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল, তবে আজিজুর রহমান সেদিন প্রাইভেট পড়াচ্ছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই।

বিষয়টি নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলেন, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জোর দাবি জানান, এমন নিকৃষ্ট চরিত্রের শিক্ষককে বিদ্যালয়ে রাখা মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা তাঁর অবিলম্বে বহিষ্কার চাই।

 

এলাকার একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন শিক্ষক হলো পিতা-মাতার সমতুল্য। কিন্তু যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে দাঁড়ান, তখন পরিবারের কোমলমতি মেয়েরা কার কাছে নিরাপদ হবে?

অন্য একজন অভিভাবক বলেন আমার মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। এমন অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছে আমি আমার সন্তানকে নিরাপদ মনে করি না।

 

প্রধান শিক্ষক প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে একমত পোষণ করে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখনও পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ঘটনাটি তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান এবং ভুক্তভোগীদের কে সরাসরি উনাকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্য বলেন। তবে অভিযুক্ত শিক্ষক আজিজুর রহমান এখনও বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিরাপদ ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয়রা।

Facebook
X
WhatsApp

মন্তব্য করুন