পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কী হয় মস্তিষ্কের, জানা গেল সাম্প্রতিক গবেষণায়

দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোন ছাড়া যেন একমুহূর্তও চলা দায়। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় স্মার্টফোনের আলোয় অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফেসবুকে স্ক্রল করে, রিল দেখে বেজে যায় ২টা-৩টা। তারপর ঘুমানো হয় বটে, কিন্তু ঘুমটা হয় না ঠিক মতো। দিনের নানা সময় তাই ঘুম হানা দেয় চোখে। কখনো চা, কখনো কফি খেয়ে টেনে চলা। আপনার রুটিনও যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে এক্ষুণি সাবধান হওয়া উচিৎ। হয়তো ভেবেছেন, ঘুম না হলে আর কীই-বা হয়, শরীর একটু ক্লান্ত লাগে, এই তো। আসলে তা নয়।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যথেষ্ট ঘুম না হলে মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না ঠিকভাবে। ফলে বর্জ্য পরিষ্কার করতে সমস্যা হয় মস্তিষ্কের। সেই ধারাবাহিকতায় স্মৃতিজনিত সমস্যা দেখা দেয়, বাড়ে আলঝেইমারের মতো স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি। সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চিন্তা করার ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এর ফলে।

এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন দ্য ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের (এইচকেইউ) প্রফেসর তাতিয়া এম সি লি। ভদ্রলোক এইচকেইউর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। ঘুম ঠিকভাবে না হলে মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ডে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন তাঁর নেতৃত্বে একদল গবেষক। ৭২ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ঘুমের রেকর্ড ও এমআরআই স্ক্যান নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা মার্কিন পাবলিশিং গ্রুপ নেচার-এর মলিকিউলার সাইক্রিয়াট্রি জার্নালে।

গবেষণার ভেতরে ঢোকার আগে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি নিয়ে খানিকটা জেনে নেওয়া যাক, চলুন।

 

যেভাবে কাজ করে মস্তিষ্ক
হয়তো মনে হতে পারে, ঘুমানোর সময় দেহের মতো মস্তিষ্কও বিশ্রাম নেয়। আসলে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো! আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, মস্তিষ্ক তখন তার সবচেয়ে জরুরি কাজগুলো শুরু করে। সারাদিন ধরে মস্তিষ্ক নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে, হাজারো স্নায়বিক সংকেত প্রক্রিয়াজাত করে, সিদ্ধান্ত নেয়, স্মৃতি গড়ে তোলে। এভাবে সে দেহের বিভিন্ন কাজ চালিয়ে নেয়। ঘুমের সময় সবচেয়ে জরুরি কাজটা হলো জমা করা অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলো বাদ দেওয়া, আর জরুরি তথ্যগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা।

তা ছাড়া সারাদিন মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কাজ করার সময় কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক তৈরি হয়। দিনভর এ রাসায়নিকগুলো জমে। এগুলো সঠিকভাবে বের করে না দিলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই বর্জ্য বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পরিষ্কারের কাজটা মস্তিষ্ক করে ঘুমের সময়। মানেটা তো বুঝতেই পারছেন। ঠিকভাবে না ঘুমালে বর্জ্য পরিষ্কার হবে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মস্তিষ্ক। বলা বাহুল্য, যত দিন যাবে, এই সমস্যা বাড়তে থাকবে। কমবে না। এই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়।

ঘুম, স্মৃতিক্ষয় ও স্নায়বিক সমস্যা
প্রফেসর লি এবং তাঁর দলের গবেষণার মূল বিষয় ছিল ‘গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম’। একধরনের নেটওয়ার্ক এটি। এর কাজই হলো মস্তিষ্কে জমা বর্জ্যগুলো পরিষ্কার করা। ইংরেজিতে বলা হয়, ফ্ল্যাশ করে দেওয়া! প্রক্রিয়াটা সরলভাবে এরকম: ঘুমের পরিমাণ ও গুণগত মান (ভালো না খারাপ) → মস্তিষ্কের বর্জ্য পরিষ্কার ব্যবস্থা → মস্তিষ্কের নেটওয়ার্কের কর্মদক্ষতা → স্মৃতি সংরক্ষণ।

প্রক্রিয়াটির দ্বিতীয় ধাপেই রয়েছে বর্জ্য পরিষ্কার, যা নির্ভর করে ঘুমের পরিমাণ ও ঘুম কতটা ভালো বা খারাপ হচ্ছে, তার ওপর। এই প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হলে বা ঠিকভাবে না হলে স্মৃতিজনিত সমস্যা হয়। পাশাপাশি কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক রয়ে যায় মস্তিষ্কের ভেতরে, জমে যেতে থাকে। আলঝেইমার, পার্কিনসনস এবং মৃগী রোগের মতো সমস্যার জন্য এগুলো দায়ী।

প্রফেসর লির নিজের ভাষ্যেই শুনুন, ‘ঘুমের পরিমাণ ও গুণগত মান, মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড এবং গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম ও মস্তিষ্কের নেটওয়ার্কের ওপর ঘুমের প্রভাব কেমন, তা বোঝা জরুরি। এতে নিউরোসাইকোলজিক্যাল বিভিন্ন প্রক্রিয়া বোঝা সম্ভব। এর মাধ্যমে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির পরিবর্তন ও স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষমতার বিভিন্ন দিক ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে।’ গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের ওপর ঘুমের প্রভাবের গুরুত্ব কী, তা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু গবেষণাটি কী বলছে? লি বলছেন, ‘এ গবেষণার ফলাফল থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কম ঘুম গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ওপর। ফলে বয়স হওয়ার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি কমতে দেখা যায়। তাই কার্যকর গ্লিম্ফ্যাটিক ফাংশন বজায় রাখা স্বাস্থ্যকরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য জরুরি।’

তাহলে কী করা উচিৎ
এটি অবশ্য সাম্প্রতিক এ গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য না। কিন্তু এই গবেষণা যেহেতু পর্যাপ্ত ঘুমের কথা বলছে, তাই কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কতটা ঘুমকে পর্যাপ্ত বলব?

বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন গড়ে ৭-৯ ঘণ্টা ভালোভাবে ঘুমালে পর্যাপ্ত ঘুম হয়। মানুষভেদে অনেকের আরও কম ঘুমেও হয়ে যায়, অনেকের হয়তো আরও খানিকটা বেশি ঘুম দরকার পড়ে। তবে শুধু সময় নয়, ঘুমের মানও গুরুত্বপূর্ণ। হালকা, আধো আধো ঘুমের চেয়ে গভীর ঘুম মস্তিষ্কের জন্য বেশি জরুরি ও কার্যকর।

মানুষের শরীরের একধরনের ঘড়ি আছে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘সার্কাডিয়ান রিদম’, আমরা বলতে পারি ‘দেহঘড়ি’। এই দেহঘড়িই ঠিক করে দেয়, কোন সময় ঘুমানো উচিৎ, কতক্ষণ ঘুমানো উচিৎ। দেহঘড়ির নিয়ম মেনে ঘুমের জন্য একটা রুটিন ঠিক করে রাখতে বলেন বিজ্ঞানীরা।

অর্থাৎ নিয়ম করে ভালোভাবে ঘুমালে মস্তিষ্ক ভালো থাকবে, কমবে স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি। শেষ করার আগে একটা মজার তথ্য দেওয়া যাক। বিবিসিসহ বিভিন্ন জায়গাতেই তথ্যটি আছে। একশ ভাগ নিশ্চিত না হলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আইনস্টাইন দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন। ধারণা করা হয়, তাঁর জিনিয়াসের পেছনে ভালো ঘুমও একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

ঠিক ধরেছেন, আইনস্টাইনের মতো হতে চাইলে ভালো করে ঘুমাতে হবে।

সূত্র: মলিকিউলার সাইক্রিয়াট্রি জার্নাল, সাইটেক ডেইলি, বিবিসি

মন্তব্য করুন