ইরান ইসরাইল যুদ্ধ,কোন দিকে মোড় নিচ্ছে!

ইসরাইল ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গতরাতেই আমি বলেছিলাম, “এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে। কাজেই সে ব্যাপারে একটি ফায়সালা ও সুস্পষ্ট ঘোষণা না দিয়ে এই যুদ্ধ থেকে ইসরাইল ও আমেরিকা কেউই পেছাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ, প্রাণহানি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ লক্ষ্যে একটি পথ হতে পারে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে বড় ধরনের হামলা করে ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করা হয়েছে’ এমন ঘোষণা দিয়ে আমেরিকা ও ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। কিন্তু ইসরাইলের এই সক্ষমতা নেই ফলে তাকে আমেরিকার সহায়তা নিতে হবে।”

আমার এই লেখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা করেছে। মূলত রাশিয়া যখন বলেছে তাদের বিজ্ঞানীরা ইরানের কোন কোন পারমাণবিক স্থাপনায় কাজ করছে তখনই বোঝা গিয়েছিল আমেরিকা হামলা করবে। এছাড়াও পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় ট্রাম্পের সাথে বৈঠক আরেকটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তবে এই হামলার কথা ইরান জানতো বলেই মনে হয়। বিশেষ করে ইরানি রাহাবারকে যখন মাজারে মাথা রেখে কাঁদতে দেখার ছবি দেখেছি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বড় কিছু করতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইরান তেজস্ক্রিয় পরমাণু রিজার্ভ এ সকল স্পট থেকে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। সেটা না হলে এতক্ষণে এ সকল স্পটে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তো যা স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়তো।

বলা হচ্ছে, আমেরিকা ফোর্ডে ছয়টি ৩০ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার নিক্ষেপ করেছে। এই হামলার যে সমস্ত ফুটেজ ইতোমধ্যেই দেখা গিয়েছে তাতে বিশাল প্রাইমারি বিস্ফোরণের ছবি এবং পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের ছবি দেখা গিয়েছে। এতে বোঝা যায়, সাইটটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এই বোমাগুলো ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে প্রবেশ করতে পেরেছে কিনা তা এখনই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কেননা বাঙ্কারে প্রবেশ করলে প্রাইমারি বিস্ফোরণ পরবর্তী একাধিক বিস্ফোরণের ছবি ধরা পড়তো। অন্যদিকে নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে আমেরিকা মূলত টমা হক ক্রুজ মিজাইল নিক্ষেপ করেছে। এগুলো বহুল ব্যবহৃত ও পরীক্ষিত মিসাইল। এগুলো ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার বিস্ফোরক নয়। এতে ওই স্পট গুলোর সারফেসে থাকা অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

আমার গতকালের একই পোস্টে আরো লিখেছিলাম,
“এ ধরনের পরিস্থিতিতে নতুন দুটো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত পারমাণবিক কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া যার দায়ভার আমেরিকাকে নিতে হবে বহুদিন। দ্বিতীয়তঃ এ ধরনের হামলা করার পরেও ইরানকে প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা নেয়া থেকে বিরত রাখা। ইরানের পক্ষেও এটা মেনে নেয়া খুবই কঠিন।” এই হামলার পরপরই ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ শান্তির কথা লিখেছেন। ট্রুথে যুদ্ধ সমাপ্তির আভাস দিয়েছেন। নেতানিয়াহুও প্রথমে শক্তি প্রয়োগ ও শান্তির কথা বলেছেন। অর্থাৎ ইরান যদি এই হামলার প্রতিশোধমূলক জবাব না দেয় তাহলে এটাই চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি বলে ট্রাম্প জয়ডংকা বাজিয়ে যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দিতে পারে। ইসরাইলও বিদ্যমান ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ইরান কী সেটা মেনে নিতে পারবে? আমাদের আরো কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। কেননা এ ধরনের ক্ষেত্রে তেহরানে রেজিম চেঞ্জ এর ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই বিপ্লব পরবর্তী ইরান প্রতিদিন চিন্তা করেছে এবং উপায় উদ্ভাবন করেছে। তবে ইরানি রাহবার যেভাবে তার তিনজন উত্তরসূরী নির্বাচন করেছেন তাতে ধারণা করা যেতে পারে, ইরান হয়তো এত সহজে মাথা নোয়াবে না। তারা গত ত্রিশ বছর ধরে বিশ্বকে বলে এসেছে, আমেরিকা যদি তাদের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ও ভূমধ্যসাগরে থাকা আমেরিকান সকল ঘাঁটি ও যুদ্ধ জাহাজে ইরান হামলা করবে। সেই হামলা করার সক্ষমতা ইরানের রয়েছে এবং এটা পরীক্ষিত। তবে এই হামলা করার আগে ইরান হয়তো চায়না ও রাশিয়ার সাথে কথা বলবে। চায়না ও রাশিয়াও ঘোষণা দিয়েছিল আমেরিকা যদি এই যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষে যায় তাহলে তারা ইরানের পক্ষে যাবে। একই কথা বলেছিল উত্তর কোরিয়াও। এটা যদি সত্যি সত্যি পুরো স্কেলে বাস্তবায়িত হয় তাহলে একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে হাঁটতে পারে বিশ্ব। তবে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে একমাত্র হুতিরাই এই হামলার পাল্টা জবাবে ইরানের সঙ্গী হবে। বাকিদের বিবেচনায় অনেকগুলো ইফ ও বাট রয়েছে।

ইরানের কাছে এই হামলার জবাব দেয়ার মত শক্তি রয়েছে। এছাড়াও তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। তবে এই প্রণালী বন্ধ করে দিলে বিশ্বে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে যা ইরানের প্রতি বিশ্বের সহানুভূতি হ্রাস করতে পারে। অন্যদিকে মার্কিন ঘাঁটি ও যুদ্ধ জাহাজ আক্রান্ত হলে তা মার্কিনী মাইটিতে আঘাত হানবে। ফলে এখন যেভাবে অধিকাংশ মার্কিনীরা এই যুদ্ধের বিরোধিতা করছে তখন আর সেটি থাকবে না। ফলে এটি পূর্ণাঙ্গ স্কেলে ইরান বনাম মার্কিন- ইসরাইল যুদ্ধে পরিণত হবে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ইরান আক্রমণ করলে ওই সকল দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হবে। ফলে সেসব দেশের মার্কিন সেবাদাস সরকার গুলো এই যুদ্ধে সরাসরি মার্কিন-ইজরায়েল এর পক্ষভূক্ত হতে পারে। ইরাক জর্ডান সিরিয়ার মত সীমান্তবর্তী দেশগুলো থেকে আমেরিকা যদি ইরানে মিজাইল ও বিমান হামলার সুযোগ পায় সেটা তাদের কৌশলগত সুবিধা এনে দেবে। এটা একটা অনেক বড় বিপদ। সার্বিকভাবে একা ইরানকে অনেকগুলো শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ মেয়াদে লড়তে হতে পারে। সেটাও ইরানকে বিবেচনায় আনতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে ইরানের দুটো গ্রস মিসটেক হয়েছে। তাহলো আমেরিকা ও ভারতকে বিশ্বাস করা। এখন বোঝা যাচ্ছে, আমেরিকা মূলত আলোচনার ফাঁদে ফেলে অপ্রস্তুত অবস্থায় ইসরাইলকে দিয়ে ইরানে আক্রমণ করিয়েছে এবং পরবর্তীকালে আরো একবার ১৫ দিনের সময়ক্ষেপণের নামে ইরানকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করেছে। ওদের বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা ঠুনকো সেটা আরো একবার প্রমাণ করেছে। সার্বিকভাবে গত রাতের হামলার মধ্য দিয়ে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ একটি নতুন মাত্রায় উপনীত হয়েছে। এখান থেকেই অনেকগুলো দিকে টার্ন নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কোন দিকে টার্ন নেবে সেটা জানতে আরো কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।

© প্যারাডক্সিকাল সাজিদ

Facebook
X
WhatsApp

মন্তব্য করুন